খুলনায় নভোথিয়েটার স্থাপন নিয়ে আলোচনা চলছে গত একযুগ ধরে। স্থান নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা কাটিয়ে ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ইতোমধ্যে দরপত্র তৈরি হয়েছে। জমিও হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু শেষ সময়ে এসে প্রকল্প থেকে পিছু হটছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাতিলের একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে খুলনার মানুষ। প্রকল্প চালু এবং দ্রুত কাজ শুরুর দাবিতে চলতি সপ্তাহেই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে নাগরিক সংগঠনগুলো। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার হুশিয়ারি দিয়েছেন নাগরিক নেতারা।
নগরীর সিএন্ডবি কলোনি এলাকায় নভোথিয়েটারটি নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে এর নাম বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার থাকলেও পরে বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বিষয়টি নিয়ে ইস্যু তৈরি করে প্রকল্প সম্পর্কে নানারকম মিথ্যা তথ্য দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধেও বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাসহ ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। তাদের অপতৎপরতায় পিছু হটছে মন্ত্রণালয়। এছাড়া সরকারের ব্যয় সংকোচনের নীতির বিষয়টিও আলোচনা হচ্ছে।
এর আগে জমি হস্তান্তরের পরও খুলনায় নৌযান ট্রেনিং ইনস্টিটিউটর ও মেরামত খানার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল কিছু ব্যক্তি। ইনস্টিটিউটটি নির্মাণ হলে প্রতিবছর ৩০০ শিক্ষার্থী সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন, কারখানায় কর্মসংস্থান হতো শতাধিক শ্রমিকের। একইভাবে জমির দলিল হস্তান্তর ও দরপত্র আহ্বানের পরও বন্ধ হয়ে গেছে আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ প্রকল্প। বর্তমানে গল্লামারীর অর্ধশত বছরের পুরানো কসাইখানায় গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে। এবার কিছু মানুষের আন্দোলনে নভোথিয়েটারের প্রকল্পও বাতিল হতে চললো। অথচ বিভাগীয় নভোথিয়েটারটি নির্মাণ হলে বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণাই পাল্টে যেত শিক্ষার্থীদের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন প্রজন্মের কাছে বিজ্ঞানকে সহজভাবে উপস্থাপন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় আগ্রহী করা, বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা দেওয়ার জন্য প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে নভোথিয়েটার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে খুলনা নভোথিয়েটারের জন্য জমি খোঁজা শুরু হয়। জমি খুঁজতেই সময় গেছে ১০ বছর। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল ও রংপুরে নভোথিয়েটারের কাজ শুরু হয়েছে। ২০২২ সালে নগরীর সিএন্ডবি কলোনির ১০ একর জমিতে নভোথিয়েটার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
খুলনায় নভোথিয়েটারের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৩ কোটি টাকা। গতবছর ২৩ এপ্রিল নভোথিয়েটার নির্মাণের জন্য কলোনির ৮ দশমিক ৩৫১ একর জমি নথোথিয়েটার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে গণপূর্ত বিভাগ। প্রকল্প এলাকায় বর্তমানে একটি মাঠ রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন এলাকার শিশু-কিশোর খেলাধুলা করে। মাঠের আবেগ কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের বিরোধিতায় নামে একটি পক্ষ।
গণপূর্ত বিভাগ থেকে জানা গেছে, ষাটের দশকে তৈরি খুলনা সিএন্ডবি কলোনি নিয়ে নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ চলছে। এর আওতায় পুরাতন ভবনগুলো ভেঙে ফেলে সেখানে বহুতল আধুনিক ভবন নির্মাণ হবে। এছাড়া আধুনিক খেলার মাঠ ও পার্ক নির্মাণ হবে। মহাপরিকল্পনায় আধুনিক খেলার মাঠটি রয়েছে বর্তমান মাঠের কিছুটা পাশে। ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত ১৩টি ভবন ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এই নিলামে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রটি জানায়, নভোথিয়েটার নির্মাণের জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে ১৩টি ভবন ভেঙে ফেলা এবং খেলার মাঠ দখল করা হচ্ছে, এবং নভোথিয়েটার হলে আবাসিক এলাকার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে-বলে প্রচারণা চালানো হয়। এতেই বিভ্রান্ত হন স্থানীয়রা।
গণপূর্ত বিভাগ খুলনা-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, গণপূর্তের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিত্যক্ত ভবন ভাঙা হচ্ছে। আরও কিছু ভবন ভাঙা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে নভোথিয়েটার প্রকল্প অনুমোদনের ৩/৪ বছর আগে থেকে। এসবের সঙ্গে নভোথিয়েটারের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। আর নভোথিয়েটার একটি বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রদর্শনী কেন্দ্র। এটি কিভাবে এলাকার ক্ষতি করবে আমার বুঝে আসে না। বরং আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত স্থাপনা, জলাধার ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ওই এলাকার সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দেবে।
কামরুল হাসান বলেন, বর্তমান খেলার মাঠটি নিচু। বর্ষার কারণে বছরের ৫ মাস মাঠ পানির নিচে থাকে। তখন খেলাধুলা করা যায় না। মহাপরিকল্পনায় বর্তমান মাঠের পাশে আধুনিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নতুন মাঠ তৈরি করা হবে। সেখানে ১০ মিনিটের বেশি পানি দাড়াবে না। সারাবছর শিশুরা খেলতে পারবে।
নভোথিয়েটার নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি দেখে আমরা খুলনায় গিয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। আমরা বলেছি, আগে নতুন খেলার মাঠ তৈরি হবে। এরপর নভোথিয়েটারের কাজ শুরু হবে। সবাই সহযোগিতার আশ^াসও দিয়েছেন। কিন্তু পরে নানা ঘটনা ঘটেছে। এই মুহূর্তে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, নভোথিয়েটার নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞান শিক্ষার ধারণাই পাল্টে দিতে পারে। গুটিকয়েক মানুষের নির্বুদ্ধিতায় পুরো বিভাগের মানুষ বঞ্চিত হতে পারে না। নভোথিয়েটারের কাজ দ্রুত শুরুর দাবিতে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় ঘেরাও করা হবে।
খুলনা গেজেট/হিমালয়